বুধবার লোকসভায় পাস হল ভারতীয় ন্যায় (দ্বিতীয়) সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা (দ্বিতীয়) সংহিতা এবং ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম (দ্বিতীয়) বিল। এই তিনটি বিলের লক্ষ্য হলো যথাক্রমে - ১৮৬০ সালে প্রবর্তিত ইন্ডিয়ান পেনাল কোড (IPC), ১৯৭৩ সালে প্রবর্তিত কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিওর (CrPC) এবং ১৮৭২ সালে প্রবর্তিত ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট কে প্রতিস্থাপন করা। ৭৫ বছর আগে ভারত স্বাধীন হলেও এখনো অবধি ভারতীয় দন্ডবিধি গুলো চলে আসছে ব্রিটিশদের নিয়মানুসারেই। তাই বলা চলে যে এই নতুন দন্ডবিধি গুলো কার্যকারী হওয়ার মাধ্যমে 'স্ব' এর পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকে আমরা আরো এক কদম এগিয়ে যাব। স্বামীজীর দৃষ্টিতে, সব দিক থেকে সমৃদ্ধশালী হওয়া সত্ত্বেও ভারতের দীর্ঘদিন পরাধীন থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হলো পরানুকরন। ব্রিটিশ প্রবর্তিত দন্ডবিধির পরিবর্তে ভারতের নিজস্ব দন্ডবিধি চালু হলে আমরা এই পরানুকরণের দোষ থেকেও মুক্তি লাভ করব। অর্থাৎ এবার স্বদেশে আমরা দেখতে পাব স্ব-দন্ডবিধি।
বলে রাখা ভালো, এতদিন ধরে যে দন্ডবিধি আমাদের স্বাধীন ভারতে চলে আসছে তা যেহেতু ভারতমাকে লুন্ঠনকারী ব্রিটিশদের তৈরি, তাই এই আইনের লক্ষ্য কখনোই ভারতীয়দের ভালো করা না। ভারতীয়দের উপর দমনপীড়নের উদ্দেশ্যেই একসময়ে প্রবর্তিত হয়েছিল এই আইনগুলি। সহজ ভাষায় বোঝালে, একটি শিশুকে যখন আমরা শাসন করি, শাস্তি দিই তখন আমাদের লক্ষ্য থাকে তার ভুলগুলি সংশোধন করে, উদ্দেশ্য থাকে তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। ঠিক সেরকমই ভারতীয় দণ্ডবিধিগুলি যখন ভারতীয়দের দ্বারা তৈরি হবে তখন সেটার উদ্দেশ্য সঠিক হবে, সেটার উদ্দেশ্য হবে সংশোধন করা। কিন্তু এতদিন ধরে চলে আসা ব্রিটিশ প্রবর্তিত এই আইনের লক্ষ্য ছিল এদেশীয় নাগরিকদের জব্দ করা কিংবা কড়া শাস্তি দেওয়া। কারণ? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বললে উদ্ধৃত করতে হয় ‘রাজভক্তি’ প্রবন্ধে তাঁর লেখার একটি অংশ — "..ভারতবর্ষের ইংরেজ হৃদয়ের কারবার কোনোদিন করে নাই। তাহারা এদেশকে হৃদয় দেয়ও নাই, এ দেশের হৃদয় চায়ও নাই, দেশের হৃদয়টা কোথায় আছে তাহার খবরও রাখে নাই।"
এবার নজর দেওয়া যাক স্বদেশের মানুষের জন্য ভারতীয়দের নিজেদের তৈরি দন্ডবিধিগুলোর দিকে। এই নতুন দন্ডবিধিতে জোর দেওয়া হয়েছে ভারতীয়তা, ভারতীয় সংবিধান এবং জনগণের কল্যাণের উপর, সাথে সাথে নেওয়া হয়েছে ঔপনিবেশিকতার ছাপ মুছে ফেলার প্রয়াসও। সেই উদ্দেশ্যে 'কুইন', 'ব্রিটিশ ইন্ডিয়া' র মতো বেশ কিছু শব্দ কে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হয়েছে। ৪৪ টি জায়গায় 'কোর্ট অফ জাস্টিস' এর পরিবর্তে শুধুমাত্র কোর্ট শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
CrPC-তে এতদিন যেখানে ৪৮৪টি ধারা ছিল, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা (দ্বিতীয়) সংহিতায় তা বাড়িয়ে ৫৩১ করা হয়েছে। ১৭৭টি ধারায় পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। সূত্র মারফত জানা গেছে, ৯টি নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছে। সাথে সাথে যুক্ত করা হয়েছে ৩৯টি উপধারাও । সেই সঙ্গে আনা হয়েছে ৪৪টি নতুন ধারাও। ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার প্রথম বিলটি তে গুরুতর অপরাধ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পলায়ন রোধ করতে এবং গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ কর্মচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাতকড়া ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হলেও সংশোধিত নাগরিক সুরক্ষা (দ্বিতীয়) সংহিতায় আর্থিক দুর্নীতিতে আটক ব্যক্তিদের হাতকড়া না লাগানোর প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এছাড়াও ছোটখাটো কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে জেলে না পাঠিয়ে সামাজিক কাজ করার যে সুপারিশ আনা হয়েছিল তাতে অভিযুক্ত কত দিন সামাজিক কাজ করতে হবে সেই নির্দেশ দিতে পারবেন প্রথম শ্রেণির কোনও ম্যাজিস্ট্রেট। (সূত্র - Press Information Bureau)
অপরদিকে, ভারতীয় ন্যায় (দ্বিতীয়) সংহিতা এখন ধারার সংখ্যা ৩৫৮ টি। এই বিলের প্রথম সংস্করণে যা ছিল ৩৫৬ টি ধারা নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে IPC থেকে নেওয়া ১৭৫ টি ধারা পরিবর্তন সহ নতুন এই দন্ডবিধিতে থেকে যুক্ত করা হয়েছে।
বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, যদিও 'রাজদ্রোহ' অপরাধ কিনা সেই বিষয় সুপ্রিম কোর্টে স্থগিত রাখা হয়েছে, কিন্তু নতুন এই দন্ডবিধিতে এর অনুরূপ একটি বিধান যুক্ত করা হয়েছে। ১৫২ ধারায় ভারতের সার্বভৌমত্ব, একতা ও অখণ্ডতার বিপন্নকারী কাজের জন্য শাস্তি দেওয়ার কথার উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ দেশবিরোধী কোনো কাজের সাথে যে আপোস করার হবে না তা স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতি, ভাষা বা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ভিত্তিতে পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তি দ্বারা সংগঠিত অপরাধ, সন্ত্রাস এবং হত্যাকেও অপরাধ হিসাবে নতুন এই দন্ডবিধিতে যুক্ত করা হয়েছে। আবার ভারতীয় ন্যায় (দ্বিতীয়) সংহিতার ১১৩ নম্বর ধারায় আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যদি কোনও ব্যক্তি নকল নোট ছাপিয়ে, বিদেশ থেকে জাল নোট এনে তা দেশীয় বাজারে ছড়িয়ে দিয়ে দেশের আর্থিক ক্ষতি করার চেষ্টা করে তাহলে তা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যারা এই ধরনের দেশবিরোধী, সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকবে তাদের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
নতুন এই দণ্ডবিধিতে শিশু ও নারীদের সুরক্ষার উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে। এই উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের নতুন অধ্যায়। প্রবর্তন করা হয়েছে শিশুর সংজ্ঞাও। নতুন এই আইনে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের কম বয়সি মহিলাকে ধর্ষণের সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড অথবা আজীবন কারাদণ্ড। গণধর্ষণের ক্ষেত্রে ২০ বছর থেকে আজীবন জেলের সাজার কথা বলা হয়েছে। ভারতীয় ন্যায় (দ্বিতীয়) সংহিতার ৮৬ নং ধারা অনুসারে, যদি কোনও মহিলার উপর তাঁর স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির কোনও সদস্যের অত্যাচার, নির্যাতন করার প্রমাণ মেলে তাহলে সেক্ষেত্রে তিন বছরের জেলের সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। নতুন এই বিলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে 'নিষ্ঠুরতা'র সংজ্ঞা। এই সংজ্ঞায় স্পষ্টতই বলা হয়েছে, শারীরিক অত্যাচারের সাথে সাথে মানসিক ভাবে যন্ত্রণা দেওয়ার বিষয়টিও নিষ্ঠুরতারই পর্যায়ভুক্ত। এই ধারা অনুযায়ী, কোনও ইচ্ছাকৃত খারাপ ব্যবহারের কারণে যদি কোনও মহিলা আত্মহত্যা করেন বা তিনি শারীরিক ভাবে গুরুতর ভাবে আঘাত পান কিংবা জীবনহানির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় তাহলে তা নিষ্ঠুরতা হিসেবে গণ্য করা হবে। ভারতীয় ন্যায় (দ্বিতীয়) সংহিতার ৭৩ নং ধারায় বলা হয়েছে যৌন হেনস্থা শিকার হওয়া কোন ব্যক্তির নাম পরিচয় যদি আদালতের নির্দেশ ছাড়া প্রকাশ করা হয় তাহলে প্রকাশকারীকে দু বছরে কারাদণ্ড ভোগ করতে হতে পারে।
সর্বোপরি ভারতীয় এই নতুন দন্ডবিধিগুলি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখব একদিকে যেমন দেশের সুরক্ষার দিকে জোর দেওয়া হয়েছে এবং দেশবিরোধী কোনো কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আপসহীনভাবে কড়া শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে ঠিক তেমনই জোর দেওয়া নারী সুরক্ষার ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ 'স্ব' আধারিত এই দন্ডবিধিতে একদিকে যেমন নিশ্চিত করা হয়েছে দেশমায়ের সুরক্ষার বিষয়টি তেমনই সুদৃঢ় করা হয়েছে মা - বোনেদের সুরক্ষাও, কারণ এই আইনের ফলে প্রশাসন আরো কড়া পদক্ষেপ নিতে পারবে এই ধরণের অপরাধগুলোর বিরুদ্ধে।