অখন্ড-মন্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্।
icon

বিচারধারা

ভারতের পুনরুত্থান
img
পণ্ডিত বামদেব শাস্ত্রী (ড. ডেভিড ফ্রলে)

সময় এসে গিয়েছে। এখন রাজনৈতিক ভারতের উচিত নিজেকে একটি সভ্যতা বলে স্বীকার করে সেটা প্রচার করা। ভারত কেবল একটি দেশ বা জাতি নয়। ভারত একটি সভ্যতা। সভ্যতা দেশের তুলনায় ব্যাপক। সভ্যতা মানুষের বুদ্ধি ও হৃদয়ে গভীরভাবে গেঁথে থাকা একটি ভাব। বহু রাজ্য ও ঐতিহাসিক কালখণ্ডকে পরিবেষ্টন করে থাকে সভ্যতা। সভ্যতা কেবল ভৌগোলিক স্থানবিশেষ বা ইতিহাসের প্রবাহ নয়। জগতের প্রাচীনতম, বিস্তৃততম ও গভীরতম সভ্যতাগুলির মধ্যে ভারত অন্যতম। অগাধ যৌগিক প্রজ্ঞা ও সর্বজনীন ধর্মের জন্য ভারত সমস্ত রাষ্ট্রের গুরুপ্রতিম।

জগতের খুব অল্প কিছু দেশই আছে যাদের সভ্যতা বলে বলা চলে। উদাহরণ স্বরূপ আমরা ইউরোপীয় সভ্যতার কথা ধরতে পারি। কিন্তু ইউরোপীয় সভ্যতা কোন একটি নির্দিষ্ট দেশের সভ্যতা বলে বলা চলে না। সম্ভবতঃ সভ্যতার নিরিখে চীনের সঙ্গে ভারতের তুলনা চলতেপারে। চীন-এশিয়ার অপর একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। তবে চীন যতটা ভারতকে প্রভাবিত করেছে, ভারতের দ্বারা চীন কেশর থেকে অনেক বেশি প্রভাবিত হয়েছে।

ভারতীয় সংস্কৃতি রাজনৈতিক রাষ্ট্রের তুলনায় অনেক ব্যাপক
প্রাথমিকভাবে ভারত একটি সভ্যতা এবং তাকে একটি রাজনৈতিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ করা চলে না। সভ্যতা রূপে ভারত সেই সময়েও টিকে থেকেছে এবং সমৃদ্ধিলাভ করেছে যখন ভারতের রাজনৈতিক একতা ছিল না অথবা ভারত বৈদেশিক শাসনের অধীন ছিল। ভারত অনুপম সভ্যতার শক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে শক্তিশালী চিন্তক, যোগী, দার্শনিক এবং শিল্পীদের জন্ম দিয়েছে। সেই শক্তি যে কোন রাজনৈতিক বা সামরিক শক্তির তুলনায় শ্রেষ্ঠ। আজও পর্যন্ত কোন সামরিক বাহিনী এই শক্তিকে নষ্ট করতে পারেনি।

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতাকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু বাস্তবে এটার গভীরতা অনেক বেশি। ১৯৪৭-এ ভারতের সামনে তার সনাতন সভ্যতার নবজাগৃতি ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ এসেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৪৭-এর পরে যারা ভারতের শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তারা সকলেই ভারতের প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্যকে অবহেলা করেছে। বামপন্থীদের মতে ১৯৪৭-এর আগে ভারত বলে কিছু ছিলই না। যেহেতু সেই সময় নিজেকে ভারত বলে পরিচয় দেয় এমন কোন জাতিরাষ্ট্রই ছিল না।

ভারত মানবের প্রাচীন আধ্যাত্মিক ঐহিত্যকে ধারণ করে আছে বামপন্থীরা ভারতের বর্ণময় উৎসব ও শিল্পময় সৌধ সমূহের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও এবং ভারতীয় সভ্যতার অঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় সভ্যতার গরিমাকে অনুধাবন করতে পারেনি। ভারতীয় যোগী ও ঋষিগণ যাঁরা সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে চৈতন্যের উপলব্ধি করেছেন তাদের থেকে ইউরোপীয় মার্ক্সবাদ ও ফ্রয়েডীয় তত্ত্বকে বামপন্থীরা নিজেদের নিকটতর বলে মনে করেছে।

১৯৪৭-এর আগে ভারত একটি হিংস্রতার আবহে পালিত সংস্কৃতির রাজনৈতিক শাসনে ছিল যে সংস্কৃতি কোনদিন ভারতের ধর্মীয় সভ্যতাকে বোঝেনি এবং সেই সভ্যতাকে নিপীড়িত করেছে। অনেক সময়ই সেই নিপীড়ন হিংস্র হয়ে উঠেছে। মুসলিম আক্রমণকারীরা ভারতকে ইসলামিক সভ্যতার রঙে রাঙাতে চেয়েছে এবং ব্রিটিশরা ইউরোপীয় বা ব্রিটিশ সভ্যতার রঙে রাঙানোর চেষ্টা করেছে। দুই দলই ভারতের প্রাচীন সভ্যতাকে সম্মান জানাতে অনিচ্ছুক ছিল। নিজেদের মানদণ্ডের ভিত্তিতে ভারতীয় সভ্যতাকে বিচার করে তারা ভারতীয় সভ্যতাকে স্ববিরোধী এবং অসংগঠিত বলে মনে করেছে। স্বাধীনতার পরেও নেহেরুবাদী সমাজবাদী ও মার্ক্সবাদীদের মিলিত গোষ্ঠী ভারতের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলিকে পাশ্চাত্যের রঙে রাঙানোর কাজ চালিয়ে গিয়েছে। কারণ, তারা সর্বদা ভারতের প্রাচীন সাংস্কৃতিক পরম্পরাকে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রূপে দেখেছে।

ভারতের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার উদ্দঘোষ একটি দেশ হিসেবে ভারতের এবং জগতের এখন যেটা করা দরকার তা হল-স্বাধীনতা, প্রগতি এবং প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার বিশ্বব্যাপী প্রসার। রাজনৈতিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের স্বাধীনতার উৎসব পালন করার সময় সুপ্রতিষ্ঠিত সভ্যতা হিসেবে ভারতের গুরুত্বের কথা অনুধাবন করা প্রয়োজন। যে সভ্যতার প্রভাব বিশ্বব্যাপী এবং যার আধ্যাত্মিক প্রভাব সমস্ত মানবীয় সীমার ঊর্ধ্বে। সময় এসে গিয়েছে। এখন রাজনৈতিক ভারতের উচিত নিজেকে একটি সভ্যতা বলে স্বীকার করে সেটা প্রচার করা, সময় এসে গিয়েছে শাশ্বত ভারতের জেগে ওঠার। সৌভাগ্যের বিষয় যে, ভারতে এখন এমন একটি সরকার আছে যে সরকার এই উপক্রম শুরু করেছে। যাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ মৌলিকভাবে বৈদেশিক সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত এমন ব্যক্তিবর্গের দ্বারা পরিচালিত দীর্ঘ শাসনকালের পরে এই সময় উপস্থিত হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী যোগের প্রভাব ভারতের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ ও বৈশ্বিক স্বীকৃতির চিহ্ন। ভারত মানবের প্রাচীন আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে। ভারত প্রজ্ঞাবান ঋষি ও যোগীদের দর্শনকে ধারণ করে আছে-যে দর্শন আজও আমাদের দেশ, কাল এবং মানুষের মতভেদ ও বিশ্বাসের বৈচিত্র্যের সীমানা পার করে এগিয়ে যাওয়ার পথে মার্গদর্শন করতে সক্ষম।

(পণ্ডিত বামদেব শাস্ত্রীকে (ডেভিড ফ্রলে) সংস্কৃত ভাষা, বেদ, ভারতীয় দর্শন এবং হিন্দু পরম্পরা ও ঐতিহ্যের বিষয়ে চলমান বিশ্বকোষ বললে অত্যুক্তি হয় না। তাঁর লিখিত এই লঘু নিবন্ধটি প্রজ্ঞা প্রবাহ ও মধ্যপ্রদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিভাগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত লোকমন্থন কার্যক্রম উপলক্ষে প্রকাশিত প্রজ্ঞা নামক স্মরণিকাতে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদক: ড. রাকেশ দাস।)